লিটনের এমন ক্ষোভ কি অমূলক?

একুশ তাপাদার
একুশ তাপাদার
27 November 2025, 06:34 AM

একটা আন্তর্জাতিক সিরিজ শুরুর আগের দিন দলের অধিনায়ক নির্বাচকদের তুলছেন কাঠগড়ায়, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের নীতির প্রতি জানাচ্ছেন তীব্র অসন্তোষ। নিরুত্তাপ সিরিজে গণমাধ্যমের জন্য উপাদেয় হলেও এই দৃশ্য যেকোন দল বা ক্রিকেট বোর্ডের জন্য অস্বস্তির। অধিনায়ক লিটন দাসের ক্ষোভের বিস্ফোরণের পর প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর ব্যাখ্যা স্পষ্ট করেছে দুজনের যোগাযোগহীনতার ছবি।

আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের আলোচনা পড়ে গেছে পেছনে। বুধবার চট্টগ্রামে লিটনের সংবাদ সম্মেলনে কথার বোমায় দল নির্বাচনে প্রক্রিয়া অনুসরণের ঘাটতি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ দলটা আসলে চলছে কীভাবে!

গত কয়েকটি ইনিংসে রান না পাওয়া শামীম হোসেন পাটোয়ারি বাদ পড়তে পারেন। তবে লিটনের দাবি অনুযায়ী তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে এই বিষয়ে নির্বাচকরা আলোচনা করেননি। ক্রিকেট অধিনায়ক নির্ভর খেলা, যেকোনো অধিনায়কের জন্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দলে কে আছেন, কে নেই এটা জানাটা অপমানের।

লিটন যদিও মুখে অপমানের কথা আনেননি। তাকে না জানিয়েই যে শামীমকে বাদ দেওয়া হয়েছে এই নির্দিষ্ট জায়গায় বহিঃপ্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। কাকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে, কেন আনা হচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে এটা আগে থেকে তিনি জানতে চেয়েছেন। তবে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ থেকে নাকি বলা হয়েছে, যে দল দেওয়া হবে সেই দল নিয়েই লিটনকে খেলতে হবে। বিশ্বকাপেও এভাবে দল দেওয়া হলে 'বাধ্য' হয়ে খেলতে হবে এমন ইঙ্গিত মিলেছে তার কণ্ঠে। এমনকি বিশ্বকাপ পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করবেন কিনা তা নিয়েও লিটনের মনে এখন গভীর অনিশ্চয়তা।

লিটনের এমন বিস্ফোরণের পর গণমাধ্যমে পাঠানো ভিডিওতে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু দিয়েছেন ব্যাখ্যা। যেখানে অধিনায়ককে গুরুত্ব না দেওয়ায়র সুর ছিলো স্পষ্ট। তিনি জানিয়েছেন, শামীমের ব্যাপারে অধিনায়ক ও কোচের আস্থার কথা তারা জেনেছেন। তবে দুই নির্বাচক নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তাদের এখতিয়ার অনুযায়ী এটা তারা করতেই পারেন। কিন্তু দল ঘোষণার আগে শামীমকে যে রাখা হচ্ছে না এই খবর অধিনায়ক ও কোচকে আগে থেকে জানানো হচ্ছে প্রক্রিয়া। সেটা যে অনুসরণ করা হয়নি আরেক নির্বাচক হাসিবুল হোসেন শান্ত নিশ্চিত করেছেন দ্য ডেইলি স্টারকে, 'শামীমকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে তবে তাকে বাদ দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়নি।'

প্রধান নির্বাচক আরও বলেছেন, 'শামীমকে বাদ দেওয়া তাদের এখতিয়ার, এজন্য কারো অনুমোদন দেওয়ার দরকার নেই।' এখানেই বেরিয়ে এসেছে যোগাযোগহীনতার চরম ঘাটতির দৃশ্য। লিটন সংবাদ সম্মেলনে একবারও বলেননি যে তার 'অনুমোদন' নেওয়া হয়নি বা ইত্যাদি। তার আক্ষেপ, হতাশার জায়গা ছিলো অন্ধকারে থাকা নিয়ে। দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়, যাকে নিয়ে অধিনায়ক বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক ভাবনা করছিলেন। তাকে বিশ্বকাপের ঠিক আগের সিরিজে বাদ দেওয়া হচ্ছে, কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে এই খবর তিনি আগে জানতে পারলেন না।

প্রধান নির্বাচকের 'কারো অনুমোদন দেওয়ার দরকার নেই' এই বাক্যটা সমাধানের বদলে নতুন করে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর নির্বাচক কমিটিকে তীব্র সমালোচনা ছিলো প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায়। দেশের অভিজ্ঞ ক্রিকেট মুখ লিপুর নির্বাচক কমিটি এই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু দিতে পারেনি, বরং প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার ঘটনা আরও বেড়েছে। কোন কোন খেলোয়াড়কে না খেলিয়েই পরের সিরিজে বাদ দেওয়ার একাধিক নজির দেখা গেছে। আবার কাকে কেন নেওয়া হচ্ছে সেই ব্যাখ্যাও স্পষ্ট হয় না সব সময়।

শামীমের জায়গায় দলে এসেছেন মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন। দুজন দুই ঘরানার ব্যাটার। নির্বাচকরাও বলেছেন অঙ্কনকে তারা বিবেচনা করছেন মিডল অর্ডারে, শামীম যেখানে খেলেন লোয়ার অর্ডারে। দলে আসা অঙ্কনের সাম্প্রতিক সময়ে পারফরম্যান্স খুবই বিবর্ণ। কদিন আগে শেষ হওয়া রাইজিং স্টার্স এশিয়া কাপে 'এ' দলের হয়ে চার ম্যাচ খেলে তিনি করতে পেরেছেন মাত্র ৩৬ রান, স্ট্রাইক রেট স্রেফ ৭৬.৫৯! এর আগে জাতীয় লিগের টি-টোয়েন্টিতেও ছিলেন ব্যর্থ। গত বিপিএলে ভালো করেছিলেন অঙ্কন, সেটা ১০ মাস আগের ঘটনা। তাও তিনি তখন খেলেছিলেন লোয়ার অর্ডারে।

পারফরম্যান্সের কারণে শামীমকে বাদ দিয়ে যাকে নেওয়া হয়েছে তার ঘরোয়া বা 'এ' দলের হয়েও নেই কোন পারফরম্যান্স।

প্রধান নির্বাচকের আরেকটা কথা আসলে আলোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন, দল দেওয়া হয়েছে প্রথম দুই ম্যাচের জন্য, সিরিজ জিতে গেলে তৃতীয় ম্যাচে বাদ পড়াদের কেউ বা নতুন কাউকে বাজিয়ে দেখা যাবে। শামীম যদি পারফরম্যান্সের কারণ বাদ পড়েন, তৃতীয় ম্যাচে কি প্রমাণ করে তিনি আবার ফিরবেন? এই বাদ পড়া কি তবে শাস্তিমূলক? এটা কি দলের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে?

লিপু প্রধান নির্বাচক হওয়ার পর চট্টগ্রামেই একটা সিরিজের মাঝপথে ওয়ানডে স্কোয়াড থেকে লিটনকে বাদ দিয়েছিলেন, দ্রুততার সঙ্গে বিকেএসপিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলতে। যদিও তিন দিনের মধ্যেই ছিলো টেস্ট সিরিজ, যেখানে লিটন আবার ছিলেন অবধারিত মুখ। এই টেনা হেঁচড়াকে তখন 'শাস্তিমূলক' হিসেবে দেখা হচ্ছিল। যা আদতে কাজে আসেনি।

অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচকের মধ্যে যদি যোগাযোগহীনতা থাকে, যার ফলে এমন অস্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয় সেটা নিরসনের জন্য ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ কোথায়? কেন সব মনোমালিন্য ভেতরেই মিটমাট করে নেওয়া হলো না? লিটনের তীর অবশ্য তাদের দিকেও। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমুল আবেদিন ফাহিমের কাছ থেকেই নাকি এসেছে, যে দল দেওয়া হবে সেই দল নিয়েই অধিনায়ককে খেলতে হবে।

দল নির্বাচনে অধিনায়কের মতটা ক্রিকেট খেলায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মাঠের খেলায় অধিনায়কই থাকেন পরিচালক।  অধিনায়ককে উপেক্ষা করার নীতি নিয়ে কোন ক্রিকেট বোর্ডই দল চালায় না।

লিটন যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে তার অসন্তুষের জায়গাটা চিহ্নিত না করলে রোগ দূর হবে না। যাকে সেনাপতি বানিয়েছেন তাকে আস্থায় না নিয়ে আপনি বড় যুদ্ধে জিতবেন কীভাবে?